সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

বঙ্গনারীর কেশসজ্জাঃ সেকাল ও একাল
✍ সায়ন দাস

                    " তাদের মাথায় কুঞ্চিত কেশ,
                   বেণীর শেষাংস শিখার মত যুক্ত। "

এই শ্লোকটি ভরতের নাট্যশাস্ত্র- র বঙ্গনারী বিবরণে লেখা পাওয়া যায়। এই লেখটি হাজার খ্রীঃপূঃ-এ মালব উপকূল থেকে পাওয়া যায়। ভাষাবিদ্ সুকুমার সেন এই শ্লোকটির বঙ্গানুবাদে বলা হয়েছেযে, " তোদের বাঁধা চুল যা সুন্দর, খোঁপার উপরে খোঁপা কেমন?"
ভাষাবিদ সুকুমার সেনের মতে 'খোঁপা' শব্দটির উদ্ভব সংস্কৃত শব্দ ' ক্ষম্পেক ' থেকে পাওয়া গেছে, যার অর্থ এঁটে সেটে যা রাখা যায়। আবার ছত্রাকের সংস্কৃত আভির্থানিক অর্থ হলো ক্ষপ বা ঝোঁপ। যা এই শব্দটি খোঁপা শব্দটির সাথে মিল খুঁজে পাওয়া যায়। মিষ্টি স্বাদের জিলিপি রকমের খোঁপা বলে একটি লোকশ্রুতি রয়েছে। সেই হাজার বছর আগে বাংলার নারীরা চুল রাখতেন। আর তাই লম্বা-লম্বা চুলে মেয়েরা নানান ধরনের খোঁপা করতেন। আর অনেক ধরনের খোঁপার পরিচয়ও মেলে। আবার খোঁপা করার সময় বিভিন্ন ধরনের ফুলের ব্যাবহার সেকাল থেকে হয়ে আসছে। প্রাচীনকালে চুলের দুধরনের খোঁপার নাম পাওয়া গেছে যথাঃ- কূরীর ও কুম্ব। যা এইধরনের খোঁপা প্রাচীন বৈদিক যুগের নারীরা অনুসরন করতেন। 
                   মালবের ধার অঞ্চল থেকে পাওয়া প্রত্ন শিলালেখে আছে মেয়ে বিক্রি হাটের বিবরণে। দাক্ষিণাত্য, কর্নাট, গুজরাট থেকে ব্যাবসায়ীরা গেছে বিক্রয়যগ্য মেয়ে নিয়ে, বঙ্গ ব্যাবসায়ীরাও তার পণ্য নিয়ে উপস্থিত। অভিজাত্যসমাজের পুরুষেরা তাদের কিনত ভোগ্যা ও পরিচারিকা হিসাবে। আর বঙ্গদেশ আগত গৌড়ী ভাষা বিক্রেতারা বরণনা করছে, " মেয়েটির চুড়ো বাঁধা খোঁপা, তাতে ছোট ছোট তারার মত ফুল"। 
কৃত্তিবাসী রামায়ণে সীতার ‘ঘন কেশপাশ যেমন চামর’, আর মঙ্গলকাব্যের কবি লহনার কেশসজ্জার বিবরণে লিখছেন, ‘আঁচড়িল কেশপাশ নানা পরবন্ধে।/ তৈলযুত হয়ে পড়ে লহনার স্কন্ধে।।/ কবরী বান্ধিল রামা নাম গুয়ামুটি।/ দর্পণে নিহালি দেখে যেন গুয়াগুটি।।’ অষ্টাদশ শতকে কবি নওয়াজিস খানের বর্ণনায় বিয়ের অনুষ্ঠানে কনে সাজানোর দৃশ্যে অনিবার্য ভাবে আসে কেশসজ্জার কথা, তাতেও খোঁপারই জয়ধ্বনি, “প্রথমে কোড়াই কেশ দিয়া চর্তুসম।/ বান্ধিল পাটের জাদে খোপা মনোরম।।/ তাহাতে মুকুতা ছড়া করিল শোভন।/ চন্দ্রিমা উদিত যেন বিদরিয়া ঘন।।” অর্থাৎ, প্রথমে চুল আঁচড়ে পাটের জাল দিয়ে খোঁপা বাঁধা হল, তাতে পরানো হল মুক্তোর মালা। কালো মেঘের মধ্য থেকে যেন উঁকি মারছে চাঁদ। আর এক কবি শুকুর মামুদ লক্ষ করেছেন বারবণিতার অঙ্গসজ্জা, নজর এড়িয়ে যাচ্ছে না মেয়েটির কেশসজ্জা: “গন্ধ পুষ্প তৈল বেশ্যা পরিল মাথাতে।/ সুবর্ণের জাদ বেশ্যা পরিল খোপাতে।” ভারতচন্দ্র রায় আবার বেণীর গুণমুগ্ধ: ‘বিননিয়া বিনোদিণী বেণীর শোভায়।/ সাপিনী তাপিনী তাপে বিবরে লুকায়।।’
১৮৯১ সালে সাজাদপুরের ঘাটে নৌকায় বসে আছেন রবীন্দ্রনাথ। খেয়াল করেছেন অনেক মেয়ের ভিড়ের মধ্যে একটি ‘অন্যরকম’ মেয়েকে। ‘ছিন্নপত্র’-তে আছে তার কথা, “বোধহয় বয়স বারো-তেরো হবে।… বেশ কালো অথচ বেশ দেখতে। ছেলেদের মত চুল ছাঁটা, তাতে মুখটি বেশ দেখাচ্ছে।” তবে এই কিশোরীর ছাঁটা-চুল যে নিতান্তই ব্যতিক্রম তার প্রমাণ বঙ্কিম-ভবানীচরণ, এমনকি রবীন্দ্রনাথের কথাসাহিত্যের নায়িকারাই। কপালকুণ্ডলার কথা ভেবে দেখুন, কিংবা ‘দুর্গেশনন্দিনী’র তিলোত্তমার কথা। তিলোত্তমার কেশবর্ণনায় বঙ্কিম লেখেন, “অতি নিবিড় বর্ণ কুঞ্চিতালক সকল ভ্রূযুগে, কপোলে, গণ্ডে, অংশে, উরসে আসিয়া পড়িয়াছে; মস্তকের পশ্চাদ্ভাগে অন্ধকারময় কেশরাশি সুবিন্যস্ত মুক্তাহারে গ্রথিত রহিয়াছে।” আবার, ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রাচীনা নবীনাকে বলছেন, “দেখ কলিকাতার রাড় মহলে হিন্দু বিবিরা মুছলমানীর চলন বলন সকল ধরিয়াছে, তাহারা আপন২ পছন্দ মত চুল কাটিয়া জুলপী বাহির করেন…।”
              অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে একটা ছড়ার চল হয়েছিল। নাতনির চুল বাঁধতে বাঁধতে ঠানদিদি ছড়া কাটতেন: “পদ্মফুলে ভোমরা ভোলে,/ ওলো, খোঁপায় ভোলে বর,/ নাতনি লো, তোর খোঁপা দেখে/ হবে, সতীন জরজর।” ইঙ্গিতটা স্পষ্ট, একাধিক সতিনের সংসারে স্বামীকে কাছে টানার প্রধান অস্ত্র খোঁপা, সরলার্থে কেশবিন্যাস। আরও একটা ছড়া এখনও শোনা যায়: “বড়লোকের বেটি লো/ তোর লম্বা লম্বা চুল,/ এমন খোঁপা বেঁধে দিব/ লক্ষ টাকা মূল।” উনিশ শতকের শেষার্ধেও জনপ্রিয় ছিল এই ছড়া: “হাতের শাখা ধবধবে বেশ,/ ঝুমকো ঢেঁড়ী দুল্ দুলে/ সিঁথেয় সিঁদুর, কাজল চোখে,/ খয়ের গোলা টিপ জ্বলে।”
                          কাজল চোখ আর ঝুমকো ‘ঢেঁড়ী-দোলানো’ ফ্যাশন জনপ্রিয়তা হারাতে শুরু করলে বাঙালি মেয়েরা প্রথমে ‘হাফ অ্যালবার্ট’, শেষে ‘ফুল অ্যালবার্ট’ ফ্যাশনে আবির্ভূতা হলেন। এই ফ্যাশনের উৎস তদানীন্তন প্রিন্স আলবার্ট। যুবরাজের টেরির নমুনা মেয়েরা আক্ষরিক অর্থে ‘শিরোধার্য’ করেছিলেন। যতীন্দ্রকুমার সেন লিখছেন: ‘অ্যালবার্ট’ বহুদিন দোর্দণ্ডপ্রতাপে ইঁহাদের সীমন্তে রাজত্ব করিয়া যখন নামিলেন, তখন ‘নেপোলিয়ন’ আসিয়া তাহার স্থান অধিকার করিলেন। …কেন যে বিশ্ববিশ্রুত ফরাসী সম্রাটের নামে এই ফ্যাশনের নামকরণ হইল তাহা বলা কঠিন— রমণীরাই ইহা জানেন।’ ছিল ‘পাতা কাটা’ কেশবাহারও। ‘দশী’ হইতে ‘পঁচিশী’ এবং তদূর্ধ্ব বয়সের নারীর মাথায় ‘পাতা’ শোভা পেত— কপালটা প্রায় অদৃশ্য হয়ে যেত। কোথাও কোথাও এই ফ্যাশনকে বলা হত ‘আলতা পাতা’। কেউ কেউ বলেন, এক ধরনের আলুর পাতায় ঢেউ-খেলানো ধার দেখেই মেয়েরা চুলে এই ‘পাতা’র সৃষ্টি করেছেন। পাঁচ-থাক (ধাপ) পাতা কাটাতেই নাকি সবচেয়ে বেশি বাহাদুরি ছিল। এমনটাও পাওয়া যাচ্ছে: ‘কোনও কোনও ফ্যাশনেবল ভাবিনী আড়াপাতা কাটিতে আরম্ভ করিয়াছেন। এ ফ্যাশনের সবই বাঁকা— কাপড় পরিবার ধরণটি পর্যন্ত। সব মেয়েরই যে এই ‘পাতা’ বা ‘নেপোলিয়ন’ পছন্দ ছিল, ভাবলে ভুল হবে। মার্জিতরুচি আধুনিকাদের “বাঁকা সীঁথি, সযত্নকৃত আলুথালু চুলে এলো খোঁপা, চোখে ফেয়ারি ‘পাঁসনে’ (Pince nez) চশমা এবং কদাচিৎ মুখে একটি আঙুল— এই হাল-ফ্যাশনের অঙ্গ,’ জানাচ্ছেন যতীন্দ্র সেন।
                       সাবেক বাংলায় খোঁপার নাম এ রকম— পান, টালি, স্বামীভুলানো, চ্যাটাই, চ্যাটাদর্মা, চ্যাটাপটি, গোলাপতোড়, অমৃতিপাক, লোটন, ল্যাজবিনুনি, খেজুরছড়ি, বিএ পাশ, হেঁটোভাঙ্গা, আতা, আঁটাসাঁটা, ডায়মন কাটা, ফুলঝাঁপা, এলোকেশী, বিনোদবেণী, ঝাপটা, ঝুঁট, বিছে, পৈঁচেফাঁস, জোড় কল্কা, বেহারী ফাঁসি, ধামা, মাতঙ্গিনী, কলকে ফুল, লাটিম, প্রজাপতি, সইয়ের বাগান, উকিলের কানে কলম, বাবুর বাগানের ফটক খোলা ইত্যাদি। সেকালে উলা, গুপ্তিপাড়া ও শান্তিপুর খোঁপার জন্য বিখ্যাত ছিল। কারও মতে বাঘনাপাড়ার মেয়েরাই খোঁপা বাঁধায় ছিল সেরা। এই দ্বন্দ্ব নিয়েও ছড়া আছে: ‘উলার মেয়ের কলকলানি,/ শান্তিপুরের চোপা,/ গুপ্তিপাড়ার হাতনাড়া, আর/ বাঘনাপাড়ার খোঁপা।’ অনেক সময় খোঁপা বাঁধা নিয়ে প্রতিযোগিতা চলত।
                   ‘এইচ বোস এন্ড কোম্পানি’র ‘কুন্তলীন’ ও ‘ক্যাষ্টারিন’ কেশ-তৈলের অভিনব বিজ্ঞাপন বেরোত পত্রপত্রিকায়। ‘ক্যাষ্টারিন’ তেলের বিজ্ঞাপনে লেখা থাকত, ‘কেশের জন্য বিজ্ঞান-সম্মত বিশুদ্ধ সুগন্ধি ক্যাষ্টর-অয়েল।’ একটি বিজ্ঞাপনের শিরোনাম ‘পতিব্রতা পত্নীর পত্র’।  প্রবাসী স্বামীর প্রতি পত্নীর চিঠি— ২৮ পঙ্‌ক্তিতে, পয়ার ছন্দে লেখা। আশ্বিন মাস সমাগত, তাও পতিদেবতার বাড়ি ফেরার লক্ষণ নেই। অন্য স্বামীরা কত বউ-সোহাগী, কিন্তু তার কপালে জুটেছে ‘যমেও না-ভোলা’ এক উদাসীন, সংসারবিমুখ স্বামী। তাই পত্নীটি লিখছেন: “ওরে ড্যাকরা অলপ্পেয়ে বাড়ী আসবি কবে?/ মুড়ো ঝ্যাঁটা নিয়ে কিরে পথ চাইতে হবে?/…তেল অভাবে রুক্ষ চুল অর্দ্ধেক গেছে পেকে;/ ঔষধ বিনে ওরে ড্যাকরা ঘিরলো মাথা টাকে।/... কুন্তলীন তেলটা নাকি ভাল সবার চেয়ে,/ ভাল চাও তো তাই আনবে দো-মনা না হ’য়ে।’

বিশ শতকের প্রথম দুই দশকে বাঙালি ললনারা পুরনো ও নতুন যে খোঁপাগুলোতে অনন্যা হয়ে উঠেছিলেন, তাদের একটি সচিত্র তালিকা দিয়েছিলেন যতীন্দ্রকুমার সেন। ‘মানসী ও মর্ম্মবাণী’ পত্রিকার ১৩২৬ আশ্বিন সংখ্যায় প্রকাশিত তাঁর ‘কামিনী-কুন্তল’ রসরচনাটিতে পাওয়া যায় বিচিত্র খোঁপার ইতিবৃত্ত। যেমন— খোট্টা খোঁপা (হিন্দুস্তানি মেয়েদের অনুকরণে), বিঁড়ে খোঁপা (তবলার বিঁড়ের মতো), বেনে খোঁপা (বণিকবাড়ির মেয়েদের আদরের কেশসজ্জা), গোঁজ খোঁপা (দ্রুত চুল বাঁধতে হলে), ভৈরবী খোঁপা (যোগিনীদের মতো), ব্রহ্মচূড় ও বৈষ্ণবচূড় (মাথার মাঝখানে), খেয়াল খোঁপা (মাথার যত্রতত্র অবস্থান), ফিরিঙ্গি খোঁপা (বিদেশিনিদের অনুকরণে), বিবি গোঁজ (অভিমানিনী অবলার খোঁপা), গোলকধাঁধা খোঁপা (কোথায় শুরু, কোথায় শেষ বোঝা যাবে না), সোহাগী খোঁপা (সহজেই খসে পড়ে), কুশন খোঁপা (মৌচাকের মতো), দোলন খোঁপা (ঘণ্টার মতো দুলতে থাকে), টায়রা খোঁপা (এতে নাকি ঘড়ি লাগানো হত!), এরোপ্লেন খোঁপা (বহু কাল আগে প্রচলিত প্রজাপতি খোঁপার দীর্ঘতম সংস্করণ, দেখতে এরোপ্লেনের মতো ছিল)। ‘এরোপ্লেন’-এর নাম শুনে যদি অবাক হন, তবে ‘তোপ খোঁপা’ দেখলে তো ভিরমি খেতে হবে। তোপ মানে কামান, কেশবতী বঙ্গনারী মাথায় আস্ত একটি ‘কামান’ বহন করতেন যেন! এরই সাম্মানিক শিরোনাম ছিল ‘জ্যাক জনসন খোঁপা’।
                খোঁপা-অভিজ্ঞতার দারুণ বর্ণনা দিয়েছেন লীলা মজুমদার। ১৯২৭-২৮, তিনি কলেজপড়ুয়া। সেই সময়ের কথা লিখছেন ‘আর কোনোখানে’ বইতে: ‘কলেজে উঠে খোঁপা বাঁধলাম। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে, একটা কালো ফিতে দিয়ে আঁটো করে চুলের গোড়া বাঁধা হল। তারপর চুলগুলোকে তিন ভাগ করে নিয়ে ফুলিয়ে, পাকিয়ে, জড়িয়ে, গোটা পনেরো দিশী সেলুলয়েডের কাঁটা গুঁজে দিব্যি এক খোঁপা হল। তবে একটা মুশকিল ছিল যে মধ্যিখানের খানিকটা মাঝে মাঝে খুলে যেত। তখন ক্লাসের জনাকুড়ি সহানুভূতিশীলা বন্ধু আবার সেটাকে যথাস্থানে গুঁজে দিত। সবারি তখন ঐ এক দশা।’ এমএ পাশ করে, শান্তিনিকেতনে গিয়ে লীলা বড় খোঁপা ত্যাগ করলেন। ধীরে ধীরে মহিলা মহল থেকেই সেগুলোর চল উঠে গেল। লীলা মজুমদার লিখছেন, ‘পরে আমাদের মেয়েরা আমাদের তখনকার ফটো দেখে হাসাহাসি করত। পঁয়ত্রিশ বছর পরে দেখি নিজেরাও সেইরকম খোঁপা বাঁধছে।’
                   কলেজছাত্রীদের চুলের ফ্যাশনকে ব্যঙ্গ করতে ছাড়েননি সমসাময়িক লেখকেরা। ‘মনশা পণ্ডিতের পাঠশালায় পড়া পাত্তাড়ি বগলে মেয়েদের আজকাল আর দেখিতে পাওয়া যায় না, তাহার পরিবর্তে দেখা যায়— মাথায় কিংবা চুলের বাঁ-দিকে ফিতে-বাঁধা, বেণী দোলান অথবা খোঁপা-বাঁধা, ‘বাসে’-চড়া মেয়েগুলিকে।’ ‘এডুকেশন্যাল ফ্যাশন’ নিয়ে চর্চায় বসতেন তির্যক দৃষ্টির কলমচিরা। যতীন সেনের মতে  নতুন এই ফ্যাশনগুলির ‘এইরূপ নাম দেওয়া যাইতে পারে’— সেঞ্চুরি প্রাইমার (এ-বি-সি-ডি পড়বার সময় মাথায় ফিতার বেড়), বিজ্ঞান রিডার (পড়ার ক্লাসে আর একটু উঠলে বেড় বাদ দিয়ে চুলের বাঁদিকে একটা ‘বো’), ম্যাট্রিকুলেশন (হালকা চুলের ফাঁপা বেণীর ডগায় ফিতার ‘টাই’)। এ ভাবে পোস্ট গ্রাজুয়েট, বিএ ফেল, প্রেমচাঁদ-রায়চাঁদ খোঁপার নাম প্রস্তাব করেছেন লেখক, যার থেকে বোঝা যায় ‘নারীশিক্ষা’ বিষয়ে কতটা অন্ধকার তখনও সমাজ-মানসে ছিল।

কেশসজ্জার এত বাহার, এমন শ্রী ঢেউ তুলত না হিন্দু বিধবার সাজ-পোশাকে। কেশপ্রসাধনের তো উপায়ই ছিল না তাদের। বয়স দশ হোক কিংবা চল্লিশ, বৈধব্যের অভিজ্ঞান সাদা থান আর মুণ্ডিত মস্তক। কেশবৃদ্ধির সুযোগ ছিল না, তার আগেই ছোট ছোট করে ছেঁটে ফেলা হত, যাতে তার চেহারার মধ্যে আকর্ষণের লক্ষণাদি না থাকে। কিছুটা রেহাই পেয়েছিলেন ব্রাহ্মসমাজের বিধবা মহিলারা। সাদা থান পরলেও চুলে হাত পড়ত না। কুন্তলীন-দেলখোসের আবিষ্কর্তা, এইচ বোস এন্ড কোম্পানির হেমেন্দ্রমোহন বসুর স্ত্রী মৃণালিনী দেবী  ছিলেন লীলা মজুমদারের ছোটপিসি— ভাইপো–ভাইঝিদের আদরের সোনাপিসিমা। বেশ কম বয়সে বিধবা হয়েছিলেন তিনি। লীলা-কলমে ফুটে উঠেছে সেই অকাল-বিধবার বিবরণ: “সোনাপিসিমার বয়স তখন হয়তো বছর বেয়াল্লিশ ছিল, দেখাত আরো কম, মোমের ফুলের মতো হাত-পায়ের গড়ন।… তাঁর সুন্দর শরীরে একটিও অলঙ্কার থাকত না, সাদা থান পরা; তবু যখন ভিজে কালো চুল খুলে দাঁড়াতেন, মনে হত সেজেগুজে এসেছেন।” এভাবে শতাব্দীকাল ধরে বাঙালি নারীর চুলের সাজ এবং তার সাথে ঐতিহ্যবাহী সাজসামগ্রী হয়ে থাকুক বঙ্গকন্যাদের সৌন্দর্য ও অস্তিত্বের অনন্য প্রতীক। ভালো থাকুন, বাংলাকে ভালোবাসুন।

তথ্যসূত্র;
(১) বঙ্গীয় খোঁপার ইতিকথা (রোর মিডিয়া,URL)
(২) বাংলা দেশের ইতিহাস; রমেশচন্দ্র মজুমদার
(৩) বিভিন্ন ওয়েব সাইট(URL)
(৪) বাংলা সাহিত‍্যের ইতিহাস; সুনীতি কুমার চ‍্যাটার্জী
(৫) বাঙ্গালা সাহিত‍্যের ইতিহাস ১ ও ২ গ্ৰন্থে; সুকুমার সেন

ছবি;  সায়নী মন্ডল (বিউটিশিয়ান ও ফটোগ্ৰাফার)

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

Krishna Igor sahitya sova

                                                           কৃষ্ণনগরের সাহিত্য সভা বাংলার মুসমানদের যুগের শেষের দিকে কৃষ্ণনগরের যুগ শুরু। এর প্রাচীন নাম ছিল "রেউই"। রাজা রাঘব মাটিয়ারি থেকে রেউই গ্রামে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। রাজা রাঘবের পুত্র রাজা রুদ্র রায়ের (খ্রি:-১৬৮৩-১৬৯৪) সময় থেকে কৃষ্ণনগরের উন্নতির ইতিহাস শুরু। রাজা রুদ্র রায় রেউই নাম পরিবর্তন করে "কৃষ্ণনগর" নাম রাখেন (১৬৮৯ খ্রি:)। রাজা রুদ্র রায়ের সময়ে প্রচুর গোপ বাস করত। তারা সকলেই ভগবান শ্রী কৃষ্ণের উপাসক ছিল। রাজা রুদ্র রায় সে কারণে কৃষ্ণনগর নামকরণ করেছিলেন। রাজা রুদ্র রায়ের মৃত্যুর পর রামজীবন রাজা হয়। রাজা রামজীবন এর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র রঘুরাম ও তাঁর পুত্র কৃষ্ণচন্দ্র রাজা (খ্রি:-১৭২৮)হন। তাঁর রাজত্বকালে (১৭২৮-১৭৮২খ্রি:) কৃষ্ণনগরের প্রকৃত উন্নতি ঘটে। তাঁর গৌরবময় চরম শিখরে উন্নতি হয়, যা বাংলার গৌরবের বিষয় হয়ে দাড়ায়। তৎকালীন বঙ্গদেশে যে কয়েকটি বিখ্যাত রাজসভাছিল তা...
☯মেসোপটেমিয়া সম্পাদনায় হিজড়াদের ইতিহাস☯ ▪▪▪▪▪▪▪▪▪▪▪▪▪▪▪ "হিজড়া" শব্দটি একটি উর্দু শব্দ, যা সেমেটিক আরবি ধাতুমূল হিজর থেকে "গোত্র হতে পরিত্যাক্ত" অর্থে এসেছে এবং পরবর্তীতে তা হিন্দি ভাষায় বিদেশী শব্দ হিসেবে প্রবেশ করেছে। শব্দটির ভারতীয় ব্যবহারকে প্রথাগতভাবে ইংরেজিতে "ইউনাক" (Eunuch, অর্থঃ খোজা) বা "হারমাফ্রোডাইট" (hermaphrodite, অর্থঃ উভলিঙ্গ) হিসেবে অনুবাদ করা হয়। মেসোপটেমিয়ার পৌরাণিক কাহিনীতে মানবতার প্রাথমিক লিখিত রেকর্ডগুলির মধ্যে এমন ধরনের রেফারেন্স রয়েছে যা পুরুষও নয় এবং নারীও নয়। দ্বিতীয় সহস্রাব্দের একটি প্রস্তর ট্যাবলেট পাওয়া সুমেরীয় সৃষ্টি কাহিনীতে, দেবী নিনমা এমন ফ্যাশন করেছিলেন যেখানে "কোন পুরুষ অঙ্গ এবং কোন মহিলা অঙ্গ ছিলনা" যার জন্য Enki সমাজে একটি অবস্থান খুঁজে পেয়েছিল: "রাজার আগে দাঁড়ানো"। অ্যাট্রা-হাসিস (খ্রিস্টপূর্ব ১৭০০ খ্রিস্টাব্দ) এর আক্কাডিয়ান পুরাণে, পুরুষ এবং নারীদের পাশাপাশি "জনসাধারণের মধ্যে তৃতীয় শ্রেণি" প্রতিষ্ঠা করার জন্য এনকি, জন্মের দেবী নিন্তুকে উপদেশ দেয়, তাছাড়া ...

তিগোয়া হিন্দু মন্দির তিগোয়া গ্ৰাম মধ্য প্রদেশের বাহোরিবান্ডের জবলপুরের নিকটে অবস্থিত। যসেখানে বেশ কয়েকটি মন্দির রয়েছে। এই মন্দিরগুলির মধ্যে কেবলমাত্র কঙ্কালী দেবী মন্দির আজ অবধি ভালভাবে সংরক্ষণে রয়েছে। টিগোভা একটি ছোট্ট গ্রাম যা এক সময় ঝাঁঝানগড় নামে দুর্গের একটি শহর ছিল। টিগোভা বা তিগাওয়া শব্দের আক্ষরিক অনুবাদ 'তিনটি গ্রাম'। কঙ্কালী দেবীর মন্দির এবং আরেকটি বিষ্ণু মন্দির তিগাওয়া বা টিগোভা মন্দির হিসাবে পরিচিত। এই জায়গাটি পাহাড়ের কাইমুর রেঞ্জের নিকটে একটি মালভূমিতে অবস্থিত। এই অঞ্চল থেকে খননকার্যের ফলে পাওয়া গেছে নানান মৃৎশিল্প ও ইট। আলেকজান্ডার কানিংহাম ১৮৭৯ সালে অনুমান করেছিলেন যে বাহোরিবান্ড (তিগোয়া প্রায় ৪ কিলোমিটার দক্ষিণে) টলেমি থোলাবানা হিসাবে অনূদিত হয়েছিল এমন শহর হতে পারে। তিগোয়া (টিগোয়া, টিগোয়ান, তিগওয়ান) নামটি "ত্রি-গাওয়া" বা "তিনটি গ্রাম" থেকে উদ্ভূত হতে পারে, যা পাশের গ্রাম আমগোয়া এবং দেওরির উল্লেখ করে। স্থানীয় traditionতিহ্য বিশ্বাস করে যে এটির একবার দুর্গ ছিল এবং এটি প্রাচীন বাহুড়িবাঁধের শহরতলির ঝাঁঝানগড় নামে একটি বড় শহরের অংশ ছিল। এই মন্দিরে একটি গর্ভগৃহ এবং চারটি স্তম্ভ দ্বারা যুক্ত পোর্টিকো রয়েছে। পোর্টিকোটি প্যানেলযুক্ত প্রাচীর ও একটি সমতল ছাদ দিয়ে আবৃত। গর্ভগৃহের ভিতরে অবতার নরসিংহর একটি চিত্র রয়েছে। এই পোর্টিকোতে বিষ্ণু বা নারায়ণ এবং চামুণ্ডা বা কাঙ্কালী দেবীর চিত্র চিত্রিত রয়েছে। এছাড়া মন্দিরের উপরে একটি সর্পযুক্ত বৌদ্ধ তীর্থঙ্করের (সম্ভবত বুদ্ধ হবে না) একটি বৃহৎ প্রতিমা রয়েছে। তবে আমার ধারনানুযায়ী এটা কোনো তীর্থঙ্করের স্থাপত্য নয়, এটি সর্পযুক্ত বিষ্ণুর স্থাপত্য। টিগোভার স্মৃতিসৌধটিতে প্রায় ৩টি মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। তবে বর্তমানে কেবল কঙ্কালী দেবীর মন্দিরটিই দাঁড়িয়ে আছে। মন্দিরটি গুপ্ত আমলে ৫ম - ৬ষ্ঠ শতাব্দীর সময়কালে তৈরী। কানিংহাম অনুমান করেছিলেন যে মন্দিরটি প্রায় ১৯.৫ ফুট বর্গ ছিল। মন্দিরের গর্ভগৃহটি বাইরের দিকের উচ্চতা প্রায় ১২ ফুট এবং ভিতরে প্রায় ৮ ফুট বর্গ। পূর্বেই বলেছি এটি একটি সমতল ছাদ দ্বারা গঠিত। গর্ভগৃহের দরজাটি টি-আকারের কৌশল রয়েছে। মন্দিরের দরজার জামগুলি প্রবেশদ্বারটির চারপাশে এককভাবে উল্লম্ব ব্যান্ডগুলিতে খোদাই করা হয়েছে। প্রবেশদ্বারের প্রাচীরের বাম দিকে নদীর দেবী গঙ্গা একটি জলযান ধরে এবং তার কুমিরবাহানকে চড়ছেন, এবং উপরের ডানদিকে নদীর দেবী যমুনাও তাঁর কচ্ছপবাহন বেয়ে চড়ে একটি জলযান ধরে আছেন। দেবী গঙ্গা কাস্টার্ড-আপেল গাছ থেকে ফল সংগ্রহ করছেন, অন্যদিকে যমুনা একটি আমের গাছ থেকে একটি সংগ্রহ করছেন। মন্দিরের গর্ভগৃহের অভ্যন্তরে নরসিংহের একটি চিত্র রয়েছে। এছাড়া মন্দিরের মণ্ডপের পাশের দেয়ালগুলিতে বিভিন্ন ভাস্কর্যীয় প্যানেল দেখা যায়। একটি প্যানেলে চামুণ্ডা বা কঙ্কালী দেবীর চিত্র রয়েছে। আর তাই মন্দিরটি কঙ্কালি দেবীর মন্দির নামে খ্যাত। এছাড়া বিশ্রামরত ভগবান বিষ্ণুর একটি চিত্র দেখা যাবে। এখানে একটি ভাস্কর্যের প্যানেল রয়েছে যা দীর্ঘায়িত কান এবং মাথার উপরে একটি বৃহৎ মুকুটযুক্ত মানব বসা অবস্থা রয়েছে। এমন স্থাপত্য বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের ভাস্কর্যগুলিতে সাধারণত দেখা যায়। মন্দিরের অবশিষ্ট অংশগুলি পরবর্তী সময়ে নির্মিত হয়েছিল বলে মনে হয়। গর্ভগৃহটিতে দেবী দুর্গার একটি মুর্তি রয়েছে এবং সামনে বাইরের দেওয়ালটিতে ভগবান বিষ্ণু তাঁর সমস্ত অবতারের সাথে খোদাই করেছেন, যাঁরা দেবী সূর্য, দেবী চামুন্ডি এবং গণেশকে বাদ দিয়ে মূল চিত্রের চারপাশে চিত্রিত করেছেন। এই মন্দিরটির সামনে একটি বারান্দা রয়েছে যার চারটি স্তম্ভ রয়েছে। তথ্যসূত্র (১) ভারতের সাংস্কৃতিক ইতিহাস; প্রকাশ, 2005(URL) (২) হিন্দু স্থাপত্যের এনসাইক্লোপিডিয়া; প্রসন্ন কুমার আচার্য, ২০১০, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস (URL) (৩) ভারতীয় মন্দির আর্কিটেকচার; অ্যাডাম হার্ডি, 1995,অভিনব প্রকাশনা( URL) (৪) Gupta Art; Agrawala, V S 1977; Prithivi Prakashan. New Delhi. ((URL) (৫) Corpus Inscriptionum Indicarum Vol III; Bhandarkar, D R; 1981; Archaeological Survey of India; New Delhi (URL) (৬) ছবি..URL