সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

Krishna Igor sahitya sova

                                                           কৃষ্ণনগরের সাহিত্য সভা

বাংলার মুসমানদের যুগের শেষের দিকে কৃষ্ণনগরের যুগ শুরু। এর প্রাচীন নাম ছিল "রেউই"। রাজা রাঘব মাটিয়ারি থেকে রেউই গ্রামে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। রাজা রাঘবের পুত্র রাজা রুদ্র রায়ের (খ্রি:-১৬৮৩-১৬৯৪) সময় থেকে কৃষ্ণনগরের উন্নতির ইতিহাস শুরু। রাজা রুদ্র রায় রেউই নাম পরিবর্তন করে "কৃষ্ণনগর" নাম রাখেন (১৬৮৯ খ্রি:)। রাজা রুদ্র রায়ের সময়ে প্রচুর গোপ বাস করত। তারা সকলেই ভগবান শ্রী কৃষ্ণের উপাসক ছিল। রাজা রুদ্র রায় সে কারণে কৃষ্ণনগর নামকরণ করেছিলেন। রাজা রুদ্র রায়ের মৃত্যুর পর রামজীবন রাজা হয়। রাজা রামজীবন এর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র রঘুরাম ও তাঁর পুত্র কৃষ্ণচন্দ্র রাজা (খ্রি:-১৭২৮)হন। তাঁর রাজত্বকালে (১৭২৮-১৭৮২খ্রি:) কৃষ্ণনগরের প্রকৃত উন্নতি ঘটে। তাঁর গৌরবময় চরম শিখরে উন্নতি হয়, যা বাংলার গৌরবের বিষয় হয়ে দাড়ায়। তৎকালীন বঙ্গদেশে যে কয়েকটি বিখ্যাত রাজসভাছিল তাঁর মধ্যে কৃষ্ণনগর রাজসভা অন্যতম। রাজবাড়ীর বিষ্ণুমহলে রাজসভা বসত। এখন সে ঘর দেখলে কিছুই বোঝা যায় না। কেননা প্রচুর সংস্কারের ফলে রাজসভার চেনা রূপ আর বোঝা যায় না। তবে কৃষ্ণচন্দ্রের আমলে পাথর বসানো মেঝে দেখলে রাজসভার ঐশ্বর্য বোঝা যাবে।
            রাজসভার গুণীজন সমাবেশে যারা বসত,তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভারতচন্দ্র রায় গুনাকর অন্যতম। ভারতচন্দ্র রায়গুনাকরের ' গ্রন্থ থেকে জানা যায়, কৃষ্ণচন্দ্র একদিকে যেমন ছিলেন বিদ্যোতসাহী, তেমন অন্যদিকে শিল্পানুরাগী। তাঁর রাজসভায় জ্ঞানীগুণী ও হাস্যরসিকের সমাবেশ হয়েছিল। তিনি গুনির সমাদর করতেন। যখনই কোনো নতুন প্রতিভার সন্ধান পেতেন, তখনই তিনি তাঁকে নিজ রাজসভায় আনয়ন করিতেন। কেবল নিজ রাজ্যের মধ্যেই নই ভিনদেশে হতেও কবি ও পণ্ডিতদের রাজসভায় নিয়ে এসে, প্রতিষ্ঠিত করতেন।
        ভারতচন্দ্রের কাব্যে রাষ্ট্রকেন্দ্রীক, সামাজিক, পারিবারিক, আদিবিবিধ উপাদানের সার্থক সম্নবয় ঘটেছিল। ভারত চন্দ্রের কাব্য খ্রিষ্টীয় অষ্টাদশ শতকের আলেখ্য। জ্যোতিষ রাষ্টপণ্ডিত রামরুদ্র বিদ্যানিধি  কৃষ্ণচন্দ্রের নিত্য সহচর ছিলেন। এছাড়া নবদ্বীপের ন্যায়বিত হরিরামতর্ক সিদ্ধান্ত, কৃষ্ণানন্দ বাচস্পতি, রামগোপাল সার্বভৌম, প্রাণনাথ ন্যায় পঞ্চরত্ন, রমানন্দ বাচস্পতি, বীরেশ্বর ন্যায় পঞ্চানন ষড়দর্শন বেত্তা, শিবরাম বাচস্পতি, রামবল্লভ বিদ্যাবাগিস, রুদ্ররাম তর্কবাগিশ, বানেশ্বর বিদ্যালঙ্কার, সু গান্ধার বংশের রায় বংশের প্রতিষ্ঠাতা গোবিন্দরাম রায় (বসু), কালীঘাটের পুরোহিত বংশের আদিপুরুষ হুগলি জেলার সমড়া নিবাসী হরেকৃষ্ণ তর্কালঙ্কারের পুত্র রাধাকৃষ্ণ তর্কালঙ্কার ও সাধক রামপ্রসাদব সেন প্রমুখ পণ্ডিতগণ রাজসভা অলংকৃত করতেন। তাহলে বোঝাই যায় এতজন পণ্ডিতব্যক্তি একত্র সমাবেশে এইরকম ইতিহাস খুবই কম নজির দেখা গেছে।
            কেবল পাণ্ডিত্যপূর্ণ আলোচনা ও নতুন সাহিত্য সৃষ্টি নয়,হাস্যরসেও তখন কৃষ্ণনোগোরের বেশ সুমাম ছিল। মুক্তরাম মুখোপাধ্যায়, হস্যর্ণভ ,গোপাল ভাড় এত মনীষী দের রাজসভায় আগমন ঘটেছিল। অবশ্য গোপালভারের অস্তিত্ব নিয়েই ইতিহাসে  যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
            কৃষ্ণচন্দ্রের যুগে ভাষাচার্য চর্চার দিক থেকে ও যথেষ্ট সুখ্যাতি ছিল। নৃত্য ও সংগীত চর্চায়ও কৃষ্ণনগর বাংলার ইতিহাসে বিশেষ স্থান করেছিল। এখানে শাস্ত্রীয়, ধ্রুপদ, পাখোয়াজ ও শ্যামা সঙ্গীত ও চর্চা হতো। এদের মধ্যে অন্যতম প্রধান গায়ক বিশ্রাম খান। তিনি উত্তর ভারতীয় কালয়াত সঙ্গীতে বিশেষ পারদর্শী ছিল। এছাড়া এই যুগের তানসেন এর মত গায়কও রাজসভা অলংকৃত করতো। ভারত চন্দ্রের অন্নদামঙ্গল গ্রন্থে আরো জানা যায় যে, রাজসভার গিতানুষ্ঠনে প্রথম গান গাইতেন বাঙালি গায়ক নীলমণি ডিউ সাই। মহারাজা কৃষ্ণ চন্দ্রের গানে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে একশ বিঘা নিস্কর জমি দান করেন এবং 'কবিরঞ্জন ' উপাধি দেন করেন। আর নর্তকীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বাঙালি মোহন চন্দ্র ও ঘোষাল চন্দ্র  এছাড়া উত্তর ভারতীয় কথথক নৃত্যে প্রধান ছিলেন শের মামুদ। রাজবাড়ীর চারটে নহবতখানা রয়েছে।
        কৃষ্ণনগর শিল্পকলার ক্ষেত্রেও অসাধারণ উন্নতি লক্ষ্য করা যায়। কৃষ্ণ নগরের মৃৎ শিল্প আজ দেশে বিদেশে খ্যাতি লাভ করেছে। রাজবাড়ীর দুর্গাপ্রতিমা ' রাজরাজেশ্বরী ' র খুঁটি পুজো উল্টরথের দিনে হতো। কামান দাগাও হতো। কৃষ্ণ চন্দ্রের আমলে বারদলের মেলার প্রবর্তন হয়। পূর্বে এটি এক মাস ধরে চলত।
         স্পষ্ট বোঝা যায় কৃষ্ণচন্দ্ররের যুগে সাহিত্য, সংস্কৃতি, সঙ্গীত, ভাষা, নৃত্য, শিল্প, বাদক, স্থাপত্য, পুজাপার্বন সকল উৎসব ক্ষেত্রে এক দৃষ্টান্তস্বরুপ।

তথ্য:- (১) ভারতচন্দ্রের 'অন্নদামঙ্গল ' ।
          (২) নদিয়ার ইতিহাস -
          (৩) কৃষ্ণ নগরের ইতিহাস -
             
                                                                                                                                                   প্রবন্ধকার:- সায়ন দাস
                                                                                                                                              (ইতিহাস ও বাংলা এম.এ. র ছাত্র)
      তাং:- ০২/০৫/২০১৮

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

☯মেসোপটেমিয়া সম্পাদনায় হিজড়াদের ইতিহাস☯ ▪▪▪▪▪▪▪▪▪▪▪▪▪▪▪ "হিজড়া" শব্দটি একটি উর্দু শব্দ, যা সেমেটিক আরবি ধাতুমূল হিজর থেকে "গোত্র হতে পরিত্যাক্ত" অর্থে এসেছে এবং পরবর্তীতে তা হিন্দি ভাষায় বিদেশী শব্দ হিসেবে প্রবেশ করেছে। শব্দটির ভারতীয় ব্যবহারকে প্রথাগতভাবে ইংরেজিতে "ইউনাক" (Eunuch, অর্থঃ খোজা) বা "হারমাফ্রোডাইট" (hermaphrodite, অর্থঃ উভলিঙ্গ) হিসেবে অনুবাদ করা হয়। মেসোপটেমিয়ার পৌরাণিক কাহিনীতে মানবতার প্রাথমিক লিখিত রেকর্ডগুলির মধ্যে এমন ধরনের রেফারেন্স রয়েছে যা পুরুষও নয় এবং নারীও নয়। দ্বিতীয় সহস্রাব্দের একটি প্রস্তর ট্যাবলেট পাওয়া সুমেরীয় সৃষ্টি কাহিনীতে, দেবী নিনমা এমন ফ্যাশন করেছিলেন যেখানে "কোন পুরুষ অঙ্গ এবং কোন মহিলা অঙ্গ ছিলনা" যার জন্য Enki সমাজে একটি অবস্থান খুঁজে পেয়েছিল: "রাজার আগে দাঁড়ানো"। অ্যাট্রা-হাসিস (খ্রিস্টপূর্ব ১৭০০ খ্রিস্টাব্দ) এর আক্কাডিয়ান পুরাণে, পুরুষ এবং নারীদের পাশাপাশি "জনসাধারণের মধ্যে তৃতীয় শ্রেণি" প্রতিষ্ঠা করার জন্য এনকি, জন্মের দেবী নিন্তুকে উপদেশ দেয়, তাছাড়া ...

তিগোয়া হিন্দু মন্দির তিগোয়া গ্ৰাম মধ্য প্রদেশের বাহোরিবান্ডের জবলপুরের নিকটে অবস্থিত। যসেখানে বেশ কয়েকটি মন্দির রয়েছে। এই মন্দিরগুলির মধ্যে কেবলমাত্র কঙ্কালী দেবী মন্দির আজ অবধি ভালভাবে সংরক্ষণে রয়েছে। টিগোভা একটি ছোট্ট গ্রাম যা এক সময় ঝাঁঝানগড় নামে দুর্গের একটি শহর ছিল। টিগোভা বা তিগাওয়া শব্দের আক্ষরিক অনুবাদ 'তিনটি গ্রাম'। কঙ্কালী দেবীর মন্দির এবং আরেকটি বিষ্ণু মন্দির তিগাওয়া বা টিগোভা মন্দির হিসাবে পরিচিত। এই জায়গাটি পাহাড়ের কাইমুর রেঞ্জের নিকটে একটি মালভূমিতে অবস্থিত। এই অঞ্চল থেকে খননকার্যের ফলে পাওয়া গেছে নানান মৃৎশিল্প ও ইট। আলেকজান্ডার কানিংহাম ১৮৭৯ সালে অনুমান করেছিলেন যে বাহোরিবান্ড (তিগোয়া প্রায় ৪ কিলোমিটার দক্ষিণে) টলেমি থোলাবানা হিসাবে অনূদিত হয়েছিল এমন শহর হতে পারে। তিগোয়া (টিগোয়া, টিগোয়ান, তিগওয়ান) নামটি "ত্রি-গাওয়া" বা "তিনটি গ্রাম" থেকে উদ্ভূত হতে পারে, যা পাশের গ্রাম আমগোয়া এবং দেওরির উল্লেখ করে। স্থানীয় traditionতিহ্য বিশ্বাস করে যে এটির একবার দুর্গ ছিল এবং এটি প্রাচীন বাহুড়িবাঁধের শহরতলির ঝাঁঝানগড় নামে একটি বড় শহরের অংশ ছিল। এই মন্দিরে একটি গর্ভগৃহ এবং চারটি স্তম্ভ দ্বারা যুক্ত পোর্টিকো রয়েছে। পোর্টিকোটি প্যানেলযুক্ত প্রাচীর ও একটি সমতল ছাদ দিয়ে আবৃত। গর্ভগৃহের ভিতরে অবতার নরসিংহর একটি চিত্র রয়েছে। এই পোর্টিকোতে বিষ্ণু বা নারায়ণ এবং চামুণ্ডা বা কাঙ্কালী দেবীর চিত্র চিত্রিত রয়েছে। এছাড়া মন্দিরের উপরে একটি সর্পযুক্ত বৌদ্ধ তীর্থঙ্করের (সম্ভবত বুদ্ধ হবে না) একটি বৃহৎ প্রতিমা রয়েছে। তবে আমার ধারনানুযায়ী এটা কোনো তীর্থঙ্করের স্থাপত্য নয়, এটি সর্পযুক্ত বিষ্ণুর স্থাপত্য। টিগোভার স্মৃতিসৌধটিতে প্রায় ৩টি মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। তবে বর্তমানে কেবল কঙ্কালী দেবীর মন্দিরটিই দাঁড়িয়ে আছে। মন্দিরটি গুপ্ত আমলে ৫ম - ৬ষ্ঠ শতাব্দীর সময়কালে তৈরী। কানিংহাম অনুমান করেছিলেন যে মন্দিরটি প্রায় ১৯.৫ ফুট বর্গ ছিল। মন্দিরের গর্ভগৃহটি বাইরের দিকের উচ্চতা প্রায় ১২ ফুট এবং ভিতরে প্রায় ৮ ফুট বর্গ। পূর্বেই বলেছি এটি একটি সমতল ছাদ দ্বারা গঠিত। গর্ভগৃহের দরজাটি টি-আকারের কৌশল রয়েছে। মন্দিরের দরজার জামগুলি প্রবেশদ্বারটির চারপাশে এককভাবে উল্লম্ব ব্যান্ডগুলিতে খোদাই করা হয়েছে। প্রবেশদ্বারের প্রাচীরের বাম দিকে নদীর দেবী গঙ্গা একটি জলযান ধরে এবং তার কুমিরবাহানকে চড়ছেন, এবং উপরের ডানদিকে নদীর দেবী যমুনাও তাঁর কচ্ছপবাহন বেয়ে চড়ে একটি জলযান ধরে আছেন। দেবী গঙ্গা কাস্টার্ড-আপেল গাছ থেকে ফল সংগ্রহ করছেন, অন্যদিকে যমুনা একটি আমের গাছ থেকে একটি সংগ্রহ করছেন। মন্দিরের গর্ভগৃহের অভ্যন্তরে নরসিংহের একটি চিত্র রয়েছে। এছাড়া মন্দিরের মণ্ডপের পাশের দেয়ালগুলিতে বিভিন্ন ভাস্কর্যীয় প্যানেল দেখা যায়। একটি প্যানেলে চামুণ্ডা বা কঙ্কালী দেবীর চিত্র রয়েছে। আর তাই মন্দিরটি কঙ্কালি দেবীর মন্দির নামে খ্যাত। এছাড়া বিশ্রামরত ভগবান বিষ্ণুর একটি চিত্র দেখা যাবে। এখানে একটি ভাস্কর্যের প্যানেল রয়েছে যা দীর্ঘায়িত কান এবং মাথার উপরে একটি বৃহৎ মুকুটযুক্ত মানব বসা অবস্থা রয়েছে। এমন স্থাপত্য বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের ভাস্কর্যগুলিতে সাধারণত দেখা যায়। মন্দিরের অবশিষ্ট অংশগুলি পরবর্তী সময়ে নির্মিত হয়েছিল বলে মনে হয়। গর্ভগৃহটিতে দেবী দুর্গার একটি মুর্তি রয়েছে এবং সামনে বাইরের দেওয়ালটিতে ভগবান বিষ্ণু তাঁর সমস্ত অবতারের সাথে খোদাই করেছেন, যাঁরা দেবী সূর্য, দেবী চামুন্ডি এবং গণেশকে বাদ দিয়ে মূল চিত্রের চারপাশে চিত্রিত করেছেন। এই মন্দিরটির সামনে একটি বারান্দা রয়েছে যার চারটি স্তম্ভ রয়েছে। তথ্যসূত্র (১) ভারতের সাংস্কৃতিক ইতিহাস; প্রকাশ, 2005(URL) (২) হিন্দু স্থাপত্যের এনসাইক্লোপিডিয়া; প্রসন্ন কুমার আচার্য, ২০১০, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস (URL) (৩) ভারতীয় মন্দির আর্কিটেকচার; অ্যাডাম হার্ডি, 1995,অভিনব প্রকাশনা( URL) (৪) Gupta Art; Agrawala, V S 1977; Prithivi Prakashan. New Delhi. ((URL) (৫) Corpus Inscriptionum Indicarum Vol III; Bhandarkar, D R; 1981; Archaeological Survey of India; New Delhi (URL) (৬) ছবি..URL