সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

বাংলার দুই বিখ্যাত ময়রার কথা

   বাংলার দুই বিখ্যাত ময়রার কথা




                    বাঙালির খাওয়া-দাওয়ায় মিষ্টি অতি জনপ্রিয়। যে-কোনও উৎসব-অনুষ্ঠানে শেষ পাতে মিষ্টি ছাড়া ভাবতেই পারে না বাঙালি। কলকাতার বিখ্যাত মিষ্টি নির্মাতা দ্বারিক ঘোষ ও নবীনচন্দ্র দাস। দুই বাংলার মিষ্টির ঐতিহ্য সারা পৃথিবীর খাদ্য রসিকদের কাছে এক গবেষনার বিষয়বস্তু। আমরা বাঙালিরা ছাড়াও অসম, ত্রিপুরা, ঝাড়খন্ড ও উড়িষ্যাবাসিদেরও কাছে প্রিয় খাদ্য। তবে মিষ্টি জগতে তথা যে কোনো খাদ্যের কাছে বাঙালি শ্রেষ্ঠ। মিষ্টির এত বৈচিত্র বাঙালি ছাড়া অন্য কোনো জাতির আয়ত্তে নেই একজন রসগোল্লা নির্মাতা নবীনচন্দ্র দাস অপর জন প্রখ্যাত মিষ্টির দোকান নির্মাতা ভীম নাগ। আমি এই প্রবন্ধে দুজন ময়রার কথা বলব। এনাদের কথা না বললে মিষ্টির ইতিহাস অসম্পূর্ন রয়ে যায়।


                     বিখ্যাত ভোলা ময়রার নাম কেউ শোনেনি, এমন ব্যাক্তি খুবই কম। মহানায়ক উত্তমকুমারের অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি বাংলা চলচ্চিত্রে আমরা ভোলা ময়রার চরিত্রটি দেখতে পাই। এই ভোলা ময়রার ছোটো ছেলের মেয়ে অর্থাৎ নাতনি ক্ষিরোদমনি সঙ্গে নবীনচন্দ্র দাসের বিবাহ হয়। নবীনচন্দ্র দাস(১৮৪৫-১৯২৫)প্রখ্যাত চিনি ব্যাবসায়ী পরিবারের  মধুসূদন দাসের ঘরে জন্ম নেন।


                  নবীনচন্দ্র দাশ  ছিলেন একজন উল্লেখযোগ্য বাঙালি আবিষ্কারক, উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী এবং ১৯ শতক ও ২০ শতকের প্রথম দিকে বাংলার সাংস্কৃতিক প্রতীক। বাংলা সংস্কৃতি ও সমাজে নবীন চন্দ্র দাশের উল্লেখযোগ্য প্রধান অবদান ছিল তার উদ্ভাবনী মিষ্টান্ন যা বাঙালির জন্য পুরোপুরি নতুন মিষ্টি তৈরি করে। তার সৃষ্টিকে আজকের বাঙালি রন্ধনপ্রণালী একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং দীর্ঘস্থায়ী উপাদান গঠন করে। ব্যাপকভাবে পরিচিত বাঙালি মিষ্টি "রসোগোল্লা" বা "রসগোল্লা", ১৯ শতকের বাংলার জনপ্রিয় লিমারিকের সৃষ্টিকর্তা হিসেবে পরিচিত নবীনচন্দ্র দাশ। তাকে রসগোল্লার কলম্বাস হিসাবে উল্লেখ করা হয়। তার অন্যান্য সৃষ্টির মধ্যে রয়েছে "আবার খাবো", "দেদো সন্দেশ" এবং "বৈকুন্ঠ ভোগ",  সুপরিচিত "কস্তুরি পাক" "আতা সন্দেশ" এবং "কাঠাল সন্দেশ" প্রভৃতি। নবীনচন্দ্র দাশের তাঁর পুত্র কৃষ্ণচন্দ্র দাস (কে.সি.দাস) ও তার উত্তরসূরীরা এই মিষ্টি শিল্পটাকে অন্যত্র মাত্রায় নিয়ে গেছে। এছাড়া নবীনচন্দ্র দাসের বাংলার নবজাগরনে বিশেষ ভূমিকাও আছে।


                    উত্তর কলকাতার মিষ্টির রাজত্বে ভীমচন্দ্র নাগের মিষ্টির দোকান অন্যতম। তার আদি নিবাস ছিল হুগলি জেলার জনাই গ্রামে। হুগলি জেলার মনোহরা মিষ্টির খ্যাতির জন্য জনাই গ্রাম থেকে পিতা প্রাণচন্দ্র নাগ কলকাতায় এসে বৌবাজারে এক ছোট্ট মিষ্টির দোকান খোলেন। পরবর্তীতে ভীমচন্দ্র নাগ মহাশয় এই ক্ষুদ্র দোকানকে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে দেন।

                         রামকৃষ্ণ ও মা সারদার অত্যন্ত প্রিয় ছিল ভীমনাগের সন্দেশ। রানী রাসমনি দক্ষিনেশ্বরে যাওয়ার সময় ঠাকুর রামকৃষ্ণের জন্য ভীমনাগের সন্দেশ নিয়ে যেতেন। এছাড়া জানবাজারের রাজবাড়িতে ভীমনাগের সন্দেশ ছাড়া কোনো অনুষ্ঠান সম্পূর্ন হত না। এছাড়া স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় এর ভীমনাগের সন্দেশ খুব প্রিয় ছিল। তাই আশুতোষকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য ভীমনাগ আশুভোগ নামের একপ্রকার সন্দেশ প্রস্তুত করলেন।

     
                      ভীমচন্দ্র নাগ মনোহরা, সন্দেশ প্রভৃতি মিষ্টান্ন বিক্রি করলেও বিখ্যাত হন লেডিকেনি নামে একটি নতুন মিষ্টি তৈরী করার ফলে। ১৮৫৬-৬২ সালের মধ্যে ভারতে গভর্নর-জেনারেল চার্লস ক্যানিংয়ের স্ত্রী লেডি ক্যানিংয়ের নামে নামকরণ করা হয় মিষ্টির এবং সকলের কাছে মিষ্টিটি লেডিকেনি নামে পরিচিত হয়।



                        সুস্বাদু মিষ্টির পাশাপাশি আরও একটি ঐতিহ্য জড়িত রয়েছে ভীমনাগের সাথে। বিখ্যাত ঘড়ি নির্মাণ সংস্থা 'কুক অ্যান্ড কেলভি'-এর মালিক চার্লস কেলভি একবার এই ভীমচন্দ্র নাগের দোকানে মিষ্টি খান। ভীম চন্দ্র নাগের মিষ্টি খেয়ে একেবারে মোহিত হলেন তিনি৷ তখনই ওই সাহেব জানতে চাইলেন, এত ভাল মিষ্টি বানাও, এমন বড় দোকানে কোনও ঘড়ি নেই কেন? তখন কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন ভীম নাগ ৷ কিছুটা লজ্জিত হয়ে মাথা চুলকে বলেছিলেন “আজ্ঞে, ঘড়ি কেনা হয়ে ওঠেনি”৷ তা শুনে সাহেব জানিয়েছিলেন তিনি খুশি হয়ে এই দোকানে একটা দেওয়াল ঘড়ি উপহার দেবেন ৷ তখন নাগমশাই জানিয়েছিলেন তার কর্মচারিরা ইংরেজি পড়তে পারেন না৷ তাই অনুরোধ করেন যদি সেক্ষেত্রে বাংলায় লেখা ঘড়ি উপহার স্বরূপ দেওয়া হয়।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

☣The Sweet Renaissance☣ It was the best of times for Bengal in the second half of the nineteenth century, and the height of the golden age of Bengal’s resurgence. From fine arts to commerce, from culture to industry, from literature to science, in all things there was a glorious flowering of exuberant excellence. The spirit of this era touched the world of confectionery too. In the 1860s, the man who chose this area to engage his genius was Nobin Chandra Das (1845-1925). It was a humble beginning. In a tiny, obscure corner of Bagbazar in North Kolkata, Nobin Chandra set up a sweet shop in 1866, but the last thing he wanted was to run a mere sales counter. The passion to create something of his very own haunted him. His ambition was to create a completely original sweet, that would bring new excitement to the Bengali palate. There was in him an intense desire to create a sweetmeat that was never there before... the ultimate delicacy. He toiled for months, armed with imagination
☯মেসোপটেমিয়া সম্পাদনায় হিজড়াদের ইতিহাস☯ ▪▪▪▪▪▪▪▪▪▪▪▪▪▪▪ "হিজড়া" শব্দটি একটি উর্দু শব্দ, যা সেমেটিক আরবি ধাতুমূল হিজর থেকে "গোত্র হতে পরিত্যাক্ত" অর্থে এসেছে এবং পরবর্তীতে তা হিন্দি ভাষায় বিদেশী শব্দ হিসেবে প্রবেশ করেছে। শব্দটির ভারতীয় ব্যবহারকে প্রথাগতভাবে ইংরেজিতে "ইউনাক" (Eunuch, অর্থঃ খোজা) বা "হারমাফ্রোডাইট" (hermaphrodite, অর্থঃ উভলিঙ্গ) হিসেবে অনুবাদ করা হয়। মেসোপটেমিয়ার পৌরাণিক কাহিনীতে মানবতার প্রাথমিক লিখিত রেকর্ডগুলির মধ্যে এমন ধরনের রেফারেন্স রয়েছে যা পুরুষও নয় এবং নারীও নয়। দ্বিতীয় সহস্রাব্দের একটি প্রস্তর ট্যাবলেট পাওয়া সুমেরীয় সৃষ্টি কাহিনীতে, দেবী নিনমা এমন ফ্যাশন করেছিলেন যেখানে "কোন পুরুষ অঙ্গ এবং কোন মহিলা অঙ্গ ছিলনা" যার জন্য Enki সমাজে একটি অবস্থান খুঁজে পেয়েছিল: "রাজার আগে দাঁড়ানো"। অ্যাট্রা-হাসিস (খ্রিস্টপূর্ব ১৭০০ খ্রিস্টাব্দ) এর আক্কাডিয়ান পুরাণে, পুরুষ এবং নারীদের পাশাপাশি "জনসাধারণের মধ্যে তৃতীয় শ্রেণি" প্রতিষ্ঠা করার জন্য এনকি, জন্মের দেবী নিন্তুকে উপদেশ দেয়, তাছাড়া
☣#কামারপুকুরের_সাদা_বোঁদের_কথা☣                             "যদি কুমড়োর মত,                                   চালে ধ'রে রত,                            পানতোয়া শত শত।                            আর, সরষের মত,                                  হ'ত মিহিদানা,                             বুঁদিয়া বুটের মত।।"                       রজনীকান্ত সেনের কল্যানী কাব্যগ্ৰন্থের ঔদারীক গানে বাংলার বিভিন্ন প্রকার মিষ্টান্নের উল্লেখ করেছেন। এই গানে বুঁদিয়া বা বোঁদের উল্লেখ পাওয়া যায়।                      বোঁদে শব্দটি সংস্কৃত শব্দ বিন্দুক থেকে উদ্ধৃত হয়েছে। বিন্দুক--বুঁন্দিয়া--বুরিন্দা--বুঁদিয়া থেকে তারপর বোঁদে শব্দটি এসেছে। সিন্ধ্রি তে নুক্তি বলা হয়। প্রাচীন সাহিত্যে এই বোঁদের উল্লেখ রয়েছে। প্রচীনকালে বিরিকলাই গুড়ো, আহৃত ঘি ও চিনি সহযোগে এই মিষ্টান্ন প্রস্তুত হত। সারা ভারতীয় উপমহাদেশে বোঁদের জনপ্রিয়তা রয়েছে। বিশেষত বাংলার বোঁদে স্বনামধন্য খ্যাতি রয়েছে।                   বর্তমানে বোঁদে চালগুড়ো ও বেসন য শিয়ে জল দিয়ে মেখে আধ-ঘন্টা রেখে দিতে হয়। তারপর ছানতা (ছিদ্রযুক্ত