(ঐতিঃ)সায়ন দাস
বাংলার প্রাচীন মন্দিরগুলি শুধু দেবস্থানই নয়, সেগুলি এক-একটি ইতিহাস, পুরাতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব, লোকশ্রুতির সমন্বয় কেন্দ্র। দেবত্বকে নির্ভর করেই তৈরী হয় মন্দির, কিন্তু তার পারিপার্শ্বিক উক্ত গুণগুলিতেই মন্দির হয় কালজয়ী। তাই কোন বিগ্রহ না থাকলেও বিষ্ণুপুরের শ্যামরায় বা কৃষ্ণরায় (জোড়বাংলা) মন্দিরের দিকে তাকালে যে কোন মানুষ মোহাবিষ্ট হতে বাধ্য। আজ তেমনই এক পাথরের তৈরী মন্দিরের কথা বলব। দেবতা যেখান থেকে বহুযুগ আগেই অপসৃত, তবু তার ভাস্কর্যে মুগ্ধ হয় মন, জনশ্রুতি বলে যায় কিছু ঘটিত বা অঘটিত ঘটনা।
বাংলায় পাথরের তৈরী মন্দিরের সংখ্যা নেহাতই অল্প। বিশেষত মধ্যযুগে পাথরের মন্দির নির্মাণের সিংহভাগ কৃতিত্বই যায় মল্লরাজাদের ভাগে। বিষ্ণুপুর নগরীতে মল্লপরিবার যে সমস্ত মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, কয়েকটি ব্যতীত বেশিরভাগই সব পাথরের। শুধু তাই নয়, বিষ্ণুপুরের বাইরে যেখানে-যেখানে মল্লরাজারা মন্দিরস্থাপন করেছেন, সেগুলিও পাথরের নির্মাণ। বাঁকুড়ায় পাথরের মন্দিরগুলির বেশিরভাগেরই উপাদান হল ল্যাটেরাইট পাথর। সুতরাং এই অমসৃণ পাথরে টেরাকোটার মত নিখুঁত সুক্ষ্ম কারুকার্য করা সম্ভব হয় নি। সেই খুঁত ঢাকতে হয়েছে পঙ্খের প্রলেপ দিয়ে।
বড়জোড়া-দুর্লভপুর রোডে বড়জোড়া থেকে কিছুটা এগোলেই ডানহাতি পড়বে ঘুটগোড়িয়া গ্রাম। ঘুটগোড়িয়া গ্রামের বিপরীত প্রান্তে দূরে জনশূন্য এলাকায় বনের সন্নিকটে একটি বাঁধ, নাম লস্কর-বাঁধ। তার পাড়েই দাঁড়িয়ে আছে ‘লস্কর বাঁধের মন্দির’। দেখলে মনে হয় নির্জন একাকিত্বই এই মন্দিরের একমাত্র সঙ্গী। প্রশ্ন জাগে, গ্রাম থেকে এত দূরে নির্জন এলাকায় স্থাপন করার অর্থ কী? যদিও মন্দিরের সামনে এসে দাঁড়ালেই এই অনবদ্য সৃষ্টি সব প্রশ্নকে একটু হলেও থমকে দেয়। মন্দিরটি দেখলেই বোঝা যায়, সেই সব নাম না জানা শিল্পীর ছেনি-হাতুড়ি দিয়ে বড় বড় চৌকোন পাথরকে ভাস্কর্যে রূপ দেওয়ার শৈল্পিক শ্রমসাধ্য অবদানকে। যা এই মন্দিরকে অন্যান্য মন্দির থেকে পৃথক করে তুলেছে, অনন্য করে তুলেছে মন্দির সাম্রাজ্যে।
মন্দিরটি ওড়িয়া নাগর রীতিতে নির্মিত। দৈর্ঘ্য-প্রস্থে ৩.৬ মিটার, উচ্চতায় প্রায় ১০মিটার। উচ্চতাটি হয়ত অন্যান্য পাথরের নাগর-দেউলের থেকে খানিক ছোট। মন্দিরটি উঁচু ভিত্তিবেদীর উপর প্রতিষ্ঠিত। মন্দিরের গঠনে ল্যাটেরাইট ও বেলে পাথর উভয়ই ব্যবহৃত হয়েছে, কিন্তু সম্মুখের অলংকরণ হয়েছে বেলেপাথরে। ল্যাটেরাইট ও বেলেপাথরের এমন যুগলবন্দী বিরল! মন্দিরের গণ্ডী ও বাঢ় অংশের বিন্যাসটি পঞ্চরথ। গণ্ডী অংশে চারদিকে চারটি কারুকার্যখচিত লম্ফমান সিংহ আছে। সিংহগুলি ল্যাটেরাইট পাথরে নির্মিত। এছাড়াও নাগর-দেউলের রীতি অনুযায়ী চূড়ায় বেঁকি, আমলক, কলস প্রভৃতি অংশ দেখা যায়। গর্ভগৃহটি ছোটো ও পঙ্খের পলস্তরায় আবৃত। গর্ভগৃহে দেবতার অবস্থানের জন্য একট বৃহৎ কুলুঙ্গিও বিদ্যমান। গর্ভগৃহের ভেতর থেকে চূড়াটি চতুষ্কোনাকৃতি ধাপ যুক্ত করে যুক্ত করা হয়েছে। মন্দিরটি বহুকাল থেকেই বিগ্রহ বর্জিত ও পরিত্যক্ত।
দক্ষিণদুয়ারী এই মন্দিরের প্রবেশ পথে ফুলকাটা খিলানের শীর্ষে ও তার দুই পাশে বেলে পাথরে খোদাই করা অপরুপ সুক্ষ্ম ভাস্কর্য রয়েছে। বিষয়গুলি সবই পৌরাণিক। এই সুক্ষ্ম অলংকরণই মন্দিরটিকে অনন্যতা দান করেছে। অলংকরণগুলি ঠিক যেন টেরাকোটা ফলকের অনুকরণে নিবদ্ধ। খিলানের শীর্ষে রয়েছে সিংহ-বাহনা দ্বিভূজা দুর্গা, বৃষবাহন মহাদেব, হংসবাহন ব্রহ্মা, ঐরাবতবাহন ইন্দ্র, মৃগবাহন চন্দ্র ও ঢেঁকিবাহন নারদের মূর্তি। এই প্যানেলটির ঠিক মাঝখানে আছে লক্ষ্মী কর্তৃক পাদসেবন-রতা অনন্তশয্যাশায়ী নারায়ণের মূর্তি। প্রবেশপথের ডান ও বামদিকে আছে কৃষ্ণলীলার নানা মুহুর্তের চিত্র। সবগুলিই রাধা ও অন্যান্য গোপিনী সঙ্গে নৃত্যের দৃশ্যরূপ। খিলান অংশেও রাধাকৃষ্ণের নৃত্যমুহুর্ত, বাদ্যযন্ত্র বাদনরতা দুজন নারীমূর্তি ও দুপাশে দুটি পাখির অনুকৃতি দেখা যায়। রাধাকৃষ্ণের নৃত্যদৃশ্যের প্রাধান্য রাসলীলাকেই সূচিত করে। মনে হয়, মন্দিরটি রাধাকৃষ্ণের জন্যই উৎসর্গীকৃত হয়েছিল। ভারতীয় পুরাতত্ব সর্বেক্ষণের ফলকে এটিকে ‘রাধা-দামোদর মন্দির’ হিসাবে চিহ্নিত করা হলেও স্থানীয় অঞ্চলে এটি ‘লস্কর-বাঁধের মন্দির’ নামেই সুপরিচিত।
মন্দিরে কোন প্রতিষ্ঠালিপি ব্যবহৃত হয় নি। তাই সঠিক ভাবে বলা সম্ভব নয়, এই সুরম্য মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা কে, কতসালেই বা এই মন্দির নির্মিত হয়েছিল। ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের ফলকে এই মন্দির সপ্তদশ শতকে নির্মিত হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়েছে। বিশিষ্ট পুরাতত্ত্ববিদ্ অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘বাঁকুড়া জেলার পুরাকীর্তি’ গ্রন্থে এই মন্দিরের সময়কাল ও প্রতিষ্ঠাতা সম্বন্ধে বলেছেন—
“ এ দেবালয়টি খ্রিষ্টিয় সতেরো শতক বা আরও পরে মল্লরাজ-কুলের পৃষ্ঠপোষকতায় নির্মিত হয়েছিল বলে মনে হয়।’’
আবার বিশিষ্ট পুরাতত্ত্ববিদ্ মাণিকলাল সিংহের মতে এই মন্দিরটি মল্লরাজ বীরমল্লের প্রতিষ্ঠিত। এই বীরমল্ল হলেন মল্লভূমের বিখ্যাত নৃপতি বীরহাম্বীরের পিতামহ। সুতরাং মাণিক বাবুর মত মেনে নিলে এই মন্দিরের নির্মান কাল পিছিয়ে খ্রিষ্টিয় ষোড়শ শতাব্দীর প্রথমভাগ ধরতে হয়। তবে যাই হোক, এই মন্দিরের ভাস্কর্যের সাথে মল্লভূমের বিখ্যাত মন্দিরগুলির টেরাকোটা মূর্তি ও ফুলকারি নক্সাগুলির যে গভীর মিল, তা দেখলেই বোঝা যায়। এ প্রসঙ্গে ঘুটগোড়িয়ার নিকটবর্তী মালিয়াড়ার নবরত্ন মন্দিরের কথাও উল্লেখ করতে হয়। অধুনা প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দিরটির বেলেপাথরের খোদাই করা কৃষ্ণ ও ফুলকারি নক্সাগুলিও এই মন্দিরের সঙ্গে যথেষ্ট সাদৃশ্যপূর্ণ। সম্ভবত দুটি মন্দিরই একই সময়ে একই ব্যক্তি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত। যদিও সুস্পষ্ট প্রমাণ না থাকায় যথার্থ সিদ্ধান্ত নেওয়া খুবই কঠিন।
এরপর মন্দির সম্পর্কে স্থানীয় অঞ্চলে প্রচলিত দুটি জনশ্রুতির উল্লেখ করি। গ্রামের অনেকে বিশ্বাস করেন, কামাখ্যা থেকে আগত এক অলৌকিক ক্ষমতাধারী এক সাধু এই মন্দিরটিকে অন্য কোনস্থান থেকে রাতারাতি এখানে নিয়ে এসেছেন। বলাই বাহুল্য, এই জনশ্রুতি নিখাদ স্বপ্নে দেখা রূপকথা। গল্প ছাড়া এর বিশেষ কোন মূল্য নেই। কিন্তু আরেকটি জনশ্রুতিতে ইতিহাসের গন্ধ প্রকট। অনেকের মতে, এই মন্দির ‘গৌড় বঙ্গ উৎকল অধীপ’ মানসিংহ কর্তৃক নির্মিত। গ্রামের অধিবাসী, শিক্ষক অপূর্ব কর্মকার বলেন, শোনা যায় এই মন্দির সংলগ্ন অঞ্চলে মানসিংহের অধীনস্থ সৈন্যদের ঘাটি ছিল। এটি জনশ্রুতি হলেও তা একবাক্যে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কারণ মন্দিরের সম্মুখেই আছে বৃহৎ পুকুর, যার নাম লস্কর বাঁধ। ফার্সি শব্দ লস্কর অর্থে সৈন্য। অর্থাৎ এই জলাশয়টি সৈন্যদের ব্যবহারের জন্য খনিত হয়েছিল। তাহলে এটাও বিশ্বাস করা কঠিন হয়ে পড়ে না যে এই মন্দিরটিও সৈন্যদের ব্যবহার্থেই নির্মিত। তাই এই মন্দিরের অবস্থান মূল গ্রাম থেকে এত দূরে। মানসিংহ পরমবৈষ্ণব ছিলেন, সম্ভবত তিনি এই অঞ্চলে এসেছিলেন, তাঁর আগমন আরেকটি জনশ্রুতিতেও সমর্থিত হয়। ঘুটগোড়িয়ার পাশেই মালিয়াড়া গ্রামের চন্দ্রাধ্বূর্য রাজ বংশের পূর্বপুরুষ দেব অধূর্য নাকি এই মানসিংহের সাথেই এই অঞ্চলে এসেছিলেন এবং মালিয়াড়া গ্রামে জমিদারি পত্তন করেছিলেন। ফলে মানসিংহ সম্পর্কিত জনশ্রুতি যে একেবারে অনৈতিহাসিক, তা বলা যায় না। তবে তিনিই যে এর প্রতিষ্ঠাতা তাও সঠিকভাবে বলা যায় না।
প্রতিষ্ঠাতা নিয়ে বিতর্ক আছে, বিতর্ক আছে প্রতিষ্ঠাকাল নিয়েও। কিন্তু সব বিতর্কের ইতি মন্দিরের রম্যতায়। আজ লস্কর বাঁধের জল কমে গেছে, মজে গেছে অনেকখানি। মন্দিরের তিনদিকে গড়ে উঠেছে স্পঞ্জ আয়রণের কারখানা। ভারতীয় পুরাতত্ব সর্বেক্ষণের নিয়মকানুন না মেনেই এগুলি চলছে বহাল তবিয়তে। ছড়িয়ে দিচ্ছে নানান বিষাক্ত এসিডপূর্ণ ধোঁয়া, যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে মন্দিরের ভাস্কর্যে। এগুলির ক্ষয় আরও ত্বরান্বিত হচ্ছে তার ফলে। পুরাতত্ত্ব বিভাগের সঠিক নজরদারিও নেই বললেই চলে। কোন কর্মীও নেই। নেই মন্দিরে যাবার যথার্থ রাস্তা। রাত্রে এই অঞ্চলটি মদ্যপানের আস্তানা হয়ে ওঠে, তার নিদর্শনও ছড়িয়ে থাকে মন্দির এলাকায়! বন সন্নিকটে হওয়ায় হাতিদের আক্রমনও ঘটেছে, অনেকবার পুরাতত্ব বিভাগের প্রাচীরটি ভাঙলেও মন্দিরটির কোন ক্ষতি করেছে বলে মনে হয় না। প্রাচীর তৈরীর জন্য প্রায় এক বছর ধরে চতুর্দিকে পরিখা-প্রমাণ গর্ত করা হলেও কাজ এগোয় নি। এই সব নিয়েও একা দাঁড়িয়ে আছে লস্কর-বাঁধের মন্দির। শত শত বছর ধরে, আরও হয়ত কয়েকটা শতকের জন্য।।
বাংলার প্রাচীন মন্দিরগুলি শুধু দেবস্থানই নয়, সেগুলি এক-একটি ইতিহাস, পুরাতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব, লোকশ্রুতির সমন্বয় কেন্দ্র। দেবত্বকে নির্ভর করেই তৈরী হয় মন্দির, কিন্তু তার পারিপার্শ্বিক উক্ত গুণগুলিতেই মন্দির হয় কালজয়ী। তাই কোন বিগ্রহ না থাকলেও বিষ্ণুপুরের শ্যামরায় বা কৃষ্ণরায় (জোড়বাংলা) মন্দিরের দিকে তাকালে যে কোন মানুষ মোহাবিষ্ট হতে বাধ্য। আজ তেমনই এক পাথরের তৈরী মন্দিরের কথা বলব। দেবতা যেখান থেকে বহুযুগ আগেই অপসৃত, তবু তার ভাস্কর্যে মুগ্ধ হয় মন, জনশ্রুতি বলে যায় কিছু ঘটিত বা অঘটিত ঘটনা।
বাংলায় পাথরের তৈরী মন্দিরের সংখ্যা নেহাতই অল্প। বিশেষত মধ্যযুগে পাথরের মন্দির নির্মাণের সিংহভাগ কৃতিত্বই যায় মল্লরাজাদের ভাগে। বিষ্ণুপুর নগরীতে মল্লপরিবার যে সমস্ত মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, কয়েকটি ব্যতীত বেশিরভাগই সব পাথরের। শুধু তাই নয়, বিষ্ণুপুরের বাইরে যেখানে-যেখানে মল্লরাজারা মন্দিরস্থাপন করেছেন, সেগুলিও পাথরের নির্মাণ। বাঁকুড়ায় পাথরের মন্দিরগুলির বেশিরভাগেরই উপাদান হল ল্যাটেরাইট পাথর। সুতরাং এই অমসৃণ পাথরে টেরাকোটার মত নিখুঁত সুক্ষ্ম কারুকার্য করা সম্ভব হয় নি। সেই খুঁত ঢাকতে হয়েছে পঙ্খের প্রলেপ দিয়ে।
বড়জোড়া-দুর্লভপুর রোডে বড়জোড়া থেকে কিছুটা এগোলেই ডানহাতি পড়বে ঘুটগোড়িয়া গ্রাম। ঘুটগোড়িয়া গ্রামের বিপরীত প্রান্তে দূরে জনশূন্য এলাকায় বনের সন্নিকটে একটি বাঁধ, নাম লস্কর-বাঁধ। তার পাড়েই দাঁড়িয়ে আছে ‘লস্কর বাঁধের মন্দির’। দেখলে মনে হয় নির্জন একাকিত্বই এই মন্দিরের একমাত্র সঙ্গী। প্রশ্ন জাগে, গ্রাম থেকে এত দূরে নির্জন এলাকায় স্থাপন করার অর্থ কী? যদিও মন্দিরের সামনে এসে দাঁড়ালেই এই অনবদ্য সৃষ্টি সব প্রশ্নকে একটু হলেও থমকে দেয়। মন্দিরটি দেখলেই বোঝা যায়, সেই সব নাম না জানা শিল্পীর ছেনি-হাতুড়ি দিয়ে বড় বড় চৌকোন পাথরকে ভাস্কর্যে রূপ দেওয়ার শৈল্পিক শ্রমসাধ্য অবদানকে। যা এই মন্দিরকে অন্যান্য মন্দির থেকে পৃথক করে তুলেছে, অনন্য করে তুলেছে মন্দির সাম্রাজ্যে।
মন্দিরটি ওড়িয়া নাগর রীতিতে নির্মিত। দৈর্ঘ্য-প্রস্থে ৩.৬ মিটার, উচ্চতায় প্রায় ১০মিটার। উচ্চতাটি হয়ত অন্যান্য পাথরের নাগর-দেউলের থেকে খানিক ছোট। মন্দিরটি উঁচু ভিত্তিবেদীর উপর প্রতিষ্ঠিত। মন্দিরের গঠনে ল্যাটেরাইট ও বেলে পাথর উভয়ই ব্যবহৃত হয়েছে, কিন্তু সম্মুখের অলংকরণ হয়েছে বেলেপাথরে। ল্যাটেরাইট ও বেলেপাথরের এমন যুগলবন্দী বিরল! মন্দিরের গণ্ডী ও বাঢ় অংশের বিন্যাসটি পঞ্চরথ। গণ্ডী অংশে চারদিকে চারটি কারুকার্যখচিত লম্ফমান সিংহ আছে। সিংহগুলি ল্যাটেরাইট পাথরে নির্মিত। এছাড়াও নাগর-দেউলের রীতি অনুযায়ী চূড়ায় বেঁকি, আমলক, কলস প্রভৃতি অংশ দেখা যায়। গর্ভগৃহটি ছোটো ও পঙ্খের পলস্তরায় আবৃত। গর্ভগৃহে দেবতার অবস্থানের জন্য একট বৃহৎ কুলুঙ্গিও বিদ্যমান। গর্ভগৃহের ভেতর থেকে চূড়াটি চতুষ্কোনাকৃতি ধাপ যুক্ত করে যুক্ত করা হয়েছে। মন্দিরটি বহুকাল থেকেই বিগ্রহ বর্জিত ও পরিত্যক্ত।
দক্ষিণদুয়ারী এই মন্দিরের প্রবেশ পথে ফুলকাটা খিলানের শীর্ষে ও তার দুই পাশে বেলে পাথরে খোদাই করা অপরুপ সুক্ষ্ম ভাস্কর্য রয়েছে। বিষয়গুলি সবই পৌরাণিক। এই সুক্ষ্ম অলংকরণই মন্দিরটিকে অনন্যতা দান করেছে। অলংকরণগুলি ঠিক যেন টেরাকোটা ফলকের অনুকরণে নিবদ্ধ। খিলানের শীর্ষে রয়েছে সিংহ-বাহনা দ্বিভূজা দুর্গা, বৃষবাহন মহাদেব, হংসবাহন ব্রহ্মা, ঐরাবতবাহন ইন্দ্র, মৃগবাহন চন্দ্র ও ঢেঁকিবাহন নারদের মূর্তি। এই প্যানেলটির ঠিক মাঝখানে আছে লক্ষ্মী কর্তৃক পাদসেবন-রতা অনন্তশয্যাশায়ী নারায়ণের মূর্তি। প্রবেশপথের ডান ও বামদিকে আছে কৃষ্ণলীলার নানা মুহুর্তের চিত্র। সবগুলিই রাধা ও অন্যান্য গোপিনী সঙ্গে নৃত্যের দৃশ্যরূপ। খিলান অংশেও রাধাকৃষ্ণের নৃত্যমুহুর্ত, বাদ্যযন্ত্র বাদনরতা দুজন নারীমূর্তি ও দুপাশে দুটি পাখির অনুকৃতি দেখা যায়। রাধাকৃষ্ণের নৃত্যদৃশ্যের প্রাধান্য রাসলীলাকেই সূচিত করে। মনে হয়, মন্দিরটি রাধাকৃষ্ণের জন্যই উৎসর্গীকৃত হয়েছিল। ভারতীয় পুরাতত্ব সর্বেক্ষণের ফলকে এটিকে ‘রাধা-দামোদর মন্দির’ হিসাবে চিহ্নিত করা হলেও স্থানীয় অঞ্চলে এটি ‘লস্কর-বাঁধের মন্দির’ নামেই সুপরিচিত।
মন্দিরে কোন প্রতিষ্ঠালিপি ব্যবহৃত হয় নি। তাই সঠিক ভাবে বলা সম্ভব নয়, এই সুরম্য মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা কে, কতসালেই বা এই মন্দির নির্মিত হয়েছিল। ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের ফলকে এই মন্দির সপ্তদশ শতকে নির্মিত হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়েছে। বিশিষ্ট পুরাতত্ত্ববিদ্ অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘বাঁকুড়া জেলার পুরাকীর্তি’ গ্রন্থে এই মন্দিরের সময়কাল ও প্রতিষ্ঠাতা সম্বন্ধে বলেছেন—
“ এ দেবালয়টি খ্রিষ্টিয় সতেরো শতক বা আরও পরে মল্লরাজ-কুলের পৃষ্ঠপোষকতায় নির্মিত হয়েছিল বলে মনে হয়।’’
আবার বিশিষ্ট পুরাতত্ত্ববিদ্ মাণিকলাল সিংহের মতে এই মন্দিরটি মল্লরাজ বীরমল্লের প্রতিষ্ঠিত। এই বীরমল্ল হলেন মল্লভূমের বিখ্যাত নৃপতি বীরহাম্বীরের পিতামহ। সুতরাং মাণিক বাবুর মত মেনে নিলে এই মন্দিরের নির্মান কাল পিছিয়ে খ্রিষ্টিয় ষোড়শ শতাব্দীর প্রথমভাগ ধরতে হয়। তবে যাই হোক, এই মন্দিরের ভাস্কর্যের সাথে মল্লভূমের বিখ্যাত মন্দিরগুলির টেরাকোটা মূর্তি ও ফুলকারি নক্সাগুলির যে গভীর মিল, তা দেখলেই বোঝা যায়। এ প্রসঙ্গে ঘুটগোড়িয়ার নিকটবর্তী মালিয়াড়ার নবরত্ন মন্দিরের কথাও উল্লেখ করতে হয়। অধুনা প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দিরটির বেলেপাথরের খোদাই করা কৃষ্ণ ও ফুলকারি নক্সাগুলিও এই মন্দিরের সঙ্গে যথেষ্ট সাদৃশ্যপূর্ণ। সম্ভবত দুটি মন্দিরই একই সময়ে একই ব্যক্তি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত। যদিও সুস্পষ্ট প্রমাণ না থাকায় যথার্থ সিদ্ধান্ত নেওয়া খুবই কঠিন।
এরপর মন্দির সম্পর্কে স্থানীয় অঞ্চলে প্রচলিত দুটি জনশ্রুতির উল্লেখ করি। গ্রামের অনেকে বিশ্বাস করেন, কামাখ্যা থেকে আগত এক অলৌকিক ক্ষমতাধারী এক সাধু এই মন্দিরটিকে অন্য কোনস্থান থেকে রাতারাতি এখানে নিয়ে এসেছেন। বলাই বাহুল্য, এই জনশ্রুতি নিখাদ স্বপ্নে দেখা রূপকথা। গল্প ছাড়া এর বিশেষ কোন মূল্য নেই। কিন্তু আরেকটি জনশ্রুতিতে ইতিহাসের গন্ধ প্রকট। অনেকের মতে, এই মন্দির ‘গৌড় বঙ্গ উৎকল অধীপ’ মানসিংহ কর্তৃক নির্মিত। গ্রামের অধিবাসী, শিক্ষক অপূর্ব কর্মকার বলেন, শোনা যায় এই মন্দির সংলগ্ন অঞ্চলে মানসিংহের অধীনস্থ সৈন্যদের ঘাটি ছিল। এটি জনশ্রুতি হলেও তা একবাক্যে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কারণ মন্দিরের সম্মুখেই আছে বৃহৎ পুকুর, যার নাম লস্কর বাঁধ। ফার্সি শব্দ লস্কর অর্থে সৈন্য। অর্থাৎ এই জলাশয়টি সৈন্যদের ব্যবহারের জন্য খনিত হয়েছিল। তাহলে এটাও বিশ্বাস করা কঠিন হয়ে পড়ে না যে এই মন্দিরটিও সৈন্যদের ব্যবহার্থেই নির্মিত। তাই এই মন্দিরের অবস্থান মূল গ্রাম থেকে এত দূরে। মানসিংহ পরমবৈষ্ণব ছিলেন, সম্ভবত তিনি এই অঞ্চলে এসেছিলেন, তাঁর আগমন আরেকটি জনশ্রুতিতেও সমর্থিত হয়। ঘুটগোড়িয়ার পাশেই মালিয়াড়া গ্রামের চন্দ্রাধ্বূর্য রাজ বংশের পূর্বপুরুষ দেব অধূর্য নাকি এই মানসিংহের সাথেই এই অঞ্চলে এসেছিলেন এবং মালিয়াড়া গ্রামে জমিদারি পত্তন করেছিলেন। ফলে মানসিংহ সম্পর্কিত জনশ্রুতি যে একেবারে অনৈতিহাসিক, তা বলা যায় না। তবে তিনিই যে এর প্রতিষ্ঠাতা তাও সঠিকভাবে বলা যায় না।
প্রতিষ্ঠাতা নিয়ে বিতর্ক আছে, বিতর্ক আছে প্রতিষ্ঠাকাল নিয়েও। কিন্তু সব বিতর্কের ইতি মন্দিরের রম্যতায়। আজ লস্কর বাঁধের জল কমে গেছে, মজে গেছে অনেকখানি। মন্দিরের তিনদিকে গড়ে উঠেছে স্পঞ্জ আয়রণের কারখানা। ভারতীয় পুরাতত্ব সর্বেক্ষণের নিয়মকানুন না মেনেই এগুলি চলছে বহাল তবিয়তে। ছড়িয়ে দিচ্ছে নানান বিষাক্ত এসিডপূর্ণ ধোঁয়া, যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে মন্দিরের ভাস্কর্যে। এগুলির ক্ষয় আরও ত্বরান্বিত হচ্ছে তার ফলে। পুরাতত্ত্ব বিভাগের সঠিক নজরদারিও নেই বললেই চলে। কোন কর্মীও নেই। নেই মন্দিরে যাবার যথার্থ রাস্তা। রাত্রে এই অঞ্চলটি মদ্যপানের আস্তানা হয়ে ওঠে, তার নিদর্শনও ছড়িয়ে থাকে মন্দির এলাকায়! বন সন্নিকটে হওয়ায় হাতিদের আক্রমনও ঘটেছে, অনেকবার পুরাতত্ব বিভাগের প্রাচীরটি ভাঙলেও মন্দিরটির কোন ক্ষতি করেছে বলে মনে হয় না। প্রাচীর তৈরীর জন্য প্রায় এক বছর ধরে চতুর্দিকে পরিখা-প্রমাণ গর্ত করা হলেও কাজ এগোয় নি। এই সব নিয়েও একা দাঁড়িয়ে আছে লস্কর-বাঁধের মন্দির। শত শত বছর ধরে, আরও হয়ত কয়েকটা শতকের জন্য।।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন